74Th pOsT : প্রদীপ চক্রবর্তী


এ মাসের কবি অক্টোবর ২০১৩ প্রদীপ চক্রবর্তী

দুর্গাপুরের বাসিন্দা প্রদীপ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৭১ সালে। পেশায় স্কুলশিক্ষক প্রদীপ নব্বই দশকের বাংলা কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য নাম। প্রদীপ চক্রবর্তীর কবিতার প্রথম বই  প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। রেনবো গ্যালারিনী। তারপর এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে আরও দুটি। যথাক্রমে ছাতিম হরবোলাসুফি রংকুরুক্ষেত্র পত্রিকা সম্পাদনা করেন তিনি। প্রচুর পত্রিকায় কবিতা ও গদ্য লেখেন। একটি গদ্যের ও একটি কবিতার বই মুক্তির অপেক্ষায়।




এক ঝাঁক ভারতীয় কবিতা... ট্যাবু ও টোটেম


এক/

রাস্তার ওপর একটু দোটানায় পড়েছে পাখি
একগাছ সবুজের মধ্যে ঢুকে অন্য সবুজ থেকে
বেরিয়ে        আসছে        সে...
এমনিই
      জলের শব্দ
            মুখিয়ে আছে শরীরে
কুলুঙ্গির বুড়ো রোদ ঝিমোয়
      কখনো নিঃশর্ত অলীক সেনেগাল
উপোসী নীরবতায়
      ভোরবেলা ময়ূর হয়ে থাকে করুণাদের উঠোন

বরুণাদের ফেরত আসাটি
      দুয়ারে টাঙানো থাক
স্বভাবকুলীন সাগরে ডুবুক সাততরী দেমাক
      ভিটায় ঘুঘু চড়ুক জোড়ায় জোড়ায়

স্ফূরিত সরিয়েছে ফেনামাখা-স্তন
অঙ্গুরী  অঙ্গুলি  অবনী  আবির  ঊষসী  ঊষা
একা দেখে মনে হয় রেষারেষি আরেকটু থাকলে বেশ দেরী হয়ে যেত

মন সঙ্গতা ভালবাসি                 বল্গাহরিণের সূপ রুটি
                              ডাঁশা মাংসের ওপর স্বয়ম্ভূ খেজুর
আর এক গাছ সবুজের মধ্যে ঢুকে অন্য সবুজ থেকে প্রতিহাওয়ায়
পাখি পাখিরা শরীরে খেলছে
                  আর আমি আদ্যনাথ অমীমাংসিত ক্ষতে ব্যথাহীন,
রোদ-ঝমানো মাচায় শুয়ে       লেপকম্বল কাঁধে
বেহাগ সুরে গাইবো খালি        রাধে ময়ূরী রাধে...
দুই/

দিগ্বিদিকে ব্যাঙ মকমক করে
গুলির শব্দের মতো সমূহ পলাশ ছাড়ায় ক্রিয়া
বসন্তকালীন এই পাললিক শিল্পীর
উদ্বৃত্ত
      চিকার হয়ে
                  উড়ে যায়...


রঙের জাড়কে কে ডরায়?
তুমি কি দেখেছো নির্মলকুমারীর
                  বয়স্থ
                        রংঠুংরি
শরীরের কোরবানি ছিঁড়েছ নিজেই

বিরতি বোঝাই ঢেউ কেটে গড়ে ওঠে বাঁধ
চিকন চলাবলার মাঝে
            একটি গাগরি
            যাবতীয় চাঁদ যাকে
      বয়ঃসন্ধির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবে!


তিন/

সবশেষে লাগিয়েছি ম্লান সাইনবোর্ড ঃ
                  চাঁদবেনে এসো চাঁদবেনেরা...

জানলা থিতিয়ে যাওয়া ভিড়
            সুজ্জি বসে কাহন কাহন
                              শূন্যাতুর

চোখ আর বিষাদের মাঝামাঝি একটুকরো কাহিনী কুমির
দলিত মধুকরে         লহর         তরঙ্গ         ঊর্মি
                  প্রতিমুহূর্তে জৈবিক এক কিশোরীতে
                                    ঝটকা লেগে
রাত মজলো    ডুবলো দিন
            ঢেউফল ঢেউ রঙের ঝকঝকে স্বাস্থ্য

চুপিসাড়ে একটি কমলেকামিনী পড়ে চলে গেছে
আদিবাসী ঝিঙেফুলের ধুয়ে দিচ্ছে ভিতর পর্যন্ত
একটি আঁকাবাঁকা গাঙুর        পলাকড়ি ক্ষেত দশের দ্বিগুণ

বনবাসী কল্পসূত্রে নাগকিশোরীরা
            গরু ভেড়া নওল তাড়িয়ে ঘরে ফিরছে
বেহদ্দ মরদের বনধুঁদলির ঘরে
                  অযথা ঢিল ছুঁড়ে
                        এদিকে উদিকে পাখি ভাগিয়ে...


চার/

নীলতানের হাওয়ায়
      চিবুকের নিচে নিংড়ে, বেয়ে
            রসের ফেউয়ে
            প্রথম রক্তদাগ

বৈধ বাবনের মৃত্যু, এসো!
ঘুম আর গৌড়সারং মাঝামাঝি একটুকরো পুলক পাখি গাইছে
            আমনচূড়ায় বসে শস্যবর্ধন মন্ত্র ঃ
            ঢ্যা, ঢ্যানা ঢ্যাগ
            ঢ্যা, ঢ্যানা ঢ্যাগ
            ঢ্যা-ঢ্যা-ঢ্যা          ঢ্যাগ ঢ্যাগ
                              ঢিনি না কিতা
                              ঢিনি না কিতা
                                    কুররর...

একটি মাছরাঙা ঝুঁকে পড়া বাঁশের ডগে বসে চেয়ে আছে
মহাভিনিষ্ক্রমণ         না           মহিষবাথান?
মেঘডিলং শব্দটার মধ্যে একটা হরিয়াল পাখির হিরণ
            ছলাপাখায় বাইব নির্বিভেদ...
      দূরের জানলায় কার মুখ, দরজায়
                              কার যেন
                                    নতুন আঙুল
      সীমানায় কোন্ গাছে ফুল এসেছে দেখে...


পাঁচ/

ধীরে ধীরে
      জবরদখল হয় কুয়াশা
      এবং ঘষটানো আলোর তীব্র ঝাঁঝ ওঠে

আমি একাই ব্যস্ত ঘরে ধুম জ্বরে...
            নীলাঞ্জন এক ভাস্কর জগ
            ঘাসবর্গে প্রস্তুত পাখি
দৃশ্যত অথৈ বানান      তফা বর্ণ
                        ফুল
                        গুল
                        গন্ধ

আভিনোঁর তৃতীয় বাহু
            ঠাট বাট গ ভাও পিকাসো রোদ্দুর
দুচোখের পাতা সরিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে
                        কটা ক্রসিং
                        লোকাল উদ্বাস্তু
            কেবল ক্রশ কানেকশন হচ্ছে...
সমস্ত নিখিলকণা মুঠোর ঘৃণায় পিষে            একটা সবুজ পুকুর
                  তার জলরঙে আঁকা...


ছয়/

মাতাল সাঁওতালকুমার
আর চক্রবালে লটকেছে আধখানা মহুল
বিসর্গ ছাড়াই ক্যানেস্তারা ব্যবহৃত হবে

খুব জোর খড়ের গন্ধ
            ভরা বালতি ফাটলো ফটাস
দ্রুমিত ক্ষরণের বিকল্প রয়ে গেছে,
                  হেমন্ত ধান তাতে...

কোজাগরী            জাগরী              গরীইইই...
বুকে বুকে            নিলয়ে খোদাই         তনহাই ফাল্গুন

সাঁওতাল মেনকা                    টাঁড়
                                    বারদুয়ারি হল্ট
                              হারীত এবং হাতানিয়া দোয়ারি
                        জঙ্গল ট্রিগারে মুন্ডহীন
                                          মূর্ধাহীন
                                          আরুণি বারুদ

                        জীর্ণ যশোমতী সাজ...


সপ্ত সুরণ তিনগ্রাম


এক/

কতদূরের কম্পন ভাঙা জানলার বিষাদ আঁকতে আঁকতে সমস্ত দিনের দাগ রং মুছে দিল আর ভেতর চুঁইয়ে আচ্ছন্ন-স্তব্ধ রক্ত তার। ফোঁটা ফোঁটা হেম শষ্প। এই তার স্বভাব। একফোঁটা নিজস্ব আকাশ কিংবা একতিল অসূয়াধারা। ঢেউয়ে ঢেউয়ে যে শব্দমদিরা এমনকী পরিত্রাণহীন গভীর শব্দস্রোত, অনির্ণেয় দূর অতীতে বর্গীর ডাক, সমস্ত কষ্টের নিস্বনে পাপবোধে লঘু হয়ে যায়... মানে আর মানেহীনতার ফাঁকে দিন যায় বিকল্প জীবনে। আর ওই মাঠের যবনিকায় শিশির শেষের জতুঘর। অনেক আমনচূড়ায় ফুটে আছে গঙ্গাফড়িং। অনেক ঝরেছে...
হাত ধরো। তোমার দক্ষিণে বামে কেউ কোথথাও নেই। সবুজ মাংসটুকু পৌঁছনোর আগে শুধু ওই আভা থেকে শাণিত খড়্গের একটা সংকেত কিভাবে হয়ে ওঠে মন শ্বাস ও শোণিত? কার ছবি হারিয়ে গেল ছিঁড়তে, কুড়োতে গন্ধ নিতে ঈশপ...


দুই/

সে দেখতাম তোমায় সঙ্গ দেবে বলে দাঁড়িয়ে আছে
দিনরাতকে মাঝে নিয়ে রাস্তায় হাত নাড়ছে থেকে থেকে

তার দুঃখ হয়। জলময় নকশাদার নীল মরা পাখির পালক
স্পর্শ যেখানটায় চাঞ্চল্যজনিত অনুজ্জ্বল
তার কানে কানে রঙের শিরাবিস্তার
তার ক্ষুধাতুর তৃষা, জিভের গ্রন্থিসূত্রের ওপর
                        বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা দানা

জলের নির্ভার রেখার অস্পর্শী প্রতি কোষে কোষে
তার পাখি টোপ্পো শরীরটা
অবোধ চোখের ভরা ভাষা
জানলার পাশের পেয়ারা গাছ,
                  মসৃণ শব্দবিড়ালকে ছাড়িয়ে
            পিঁপড়ে থেকে আমি পর্যন্ত অলীক

বৃষ্টিমাখা ফুসফুস বাড়ে         দোলে         নামে
জলে খেয়াঘাটের নৌকো কারা
পুতুলের কোণে পাথরের ঝোপ হয়ে আছে
এক শিশি গন্ধের ধাঁধায় তার জ্বলছে ভারী
                        আঁটুসাঁটু যশোধারা
      আমোদগেঁড়ে পাখির জায়গায় পাখির রং...


তিন/

ফোটায় গভীর দাগ
মনস্থ জলের পাশে চোখের শমীও

যতই শেখাও হাতের পাতায় হাত মিশিয়ে
সেই বনপথে নিজস্ব বসতি, ভিতরটা স্যাঁতস্যাঁতে
এত সুরসার ফণা
একটা শূন্যমুঠি কিভাবে হয়ে ওঠে
খালি কোটর
খালি গা-ঘষটে ধরো
লাফ দাও শিহর থেকে
কত ছোট্ট পাতায় লেগে আছে
ব্যয়কুন্ঠ পর্ণমোচী
প্রতিমার খড়মাটি
শিশিরের জলে ধোয়া...


চার/

জানলা        পেলব ডানা           আলতো ছোঁওয়া
ঘাসের ভেতরে থেকে উঠে এসে তাকিয়ে রয়েছে
                              কয়েকটা পাখি

কয়েকটা পাখি অগ্রসর হয় খুব ধীরে নিঃশব্দে প্রায়

সে অক্ষর লেখে। সে মনে রাখে না। তার কি থাকতে কি নেই

তার কিছু ইতস্তত ঠোঁট জলে ভেজা
তার চিঠির অক্ষর ওলটানো টুপির ওপর

সে অক্ষর লেখে। সে মনে রাখে না। তার কি থাকতে কি নেই

সদ্য ফোটা পাখিমহল
মৃক্রীড়াসক্ত ভোর

শেষ রাতের আকাশে
ফ্রেমটা ঠিক আসছে না...